শ্রদ্ধাঞ্জলি  জান্নাতবাসী হও হে প্রিয় সহধর্মিণী

 আনোয়ার হোসেন বকুল 

গত ১৮ জুলাই দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে আমার সহধর্মিণী সেলিনা বেগম ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজেউন)। যা আমার জন্য বিনা মেঘে বজ্রপাত। আমি স্তব্ধ ও হতবাক। মন বিশ^াসই করতে চায় না- কয় ঘণ্টা আগে যার স্বাভাবিক কথপোকথন সে এভাবে চলে যেতে পারে। আমি যেন বোবা, বিস্মিত, হতবুদ্ধি। কর্তব্যরত ডাক্তার-নার্সদের নিকট ইশারায় জানতে চাইলামÑ কি হয়েছে, এমন নিথর হয়ে আমার প্রিয় সহধর্মিণী পড়ে আছে কেন? সেলিনার চলে যাওয়া আমার জন্য কত বড় শূন্যতা তা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না। সে ছিল সুচারুরূপে সংসার পরিচালনার পাশাপাশি আমাকে ধর্মীয় অনুশাসন মানাতে এক মহাশক্তি। সে শক্তি ক্যান্সার করেছে আজ ধূলায় লুণ্ঠিত।সেলিনা বেগম ১ ফেব্রæয়ারি ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার দেওলাবাড়ি ইউনিয়নের রসুলপুর (সামারগাও) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আহাম্মদ আলী আকন্দ। মাতা রেণু বেগম। পিতা আহাম্মদ আলী আকন্দ ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। গ্রাম্য মাতব্বর হিসেবে এলাকায় তার জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষণীয়। তাই ধর্মীয় অনুশাসন পালনে সেলিনার ছিল পারিবারিক যোগসূত্র। এ কারণে শিশুকাল থেকেই ধর্মানুরাগী হয়ে ওঠেন সে।সেলিনার মৃত্যুÑ এ নির্মম ঘটনায় যন্ত্রণাবিদ্ধ আমার দু’সন্তান যারিন তাসনিম শুচি ও সীমান্ত শিহাব। যে যন্ত্রণা ভাষার অতীত। সন্তানরা আজও ছটফট করছে ভেতরে ভেতরে। শোকস্তদ্ধ সন্তানরা আজ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছে। মায়ের হাতের প্রিয় খাবার, আদর-সোহাগ, গল্প সবই ঘুরে ফিরে চোখের সামনে ভাসছে তাদের। মায়ের স্মৃতি তাদের মনে পড়ছে অহরহ। পৃথিবীতে এমন কোন মহৎ কবি নেই, যে কবি মা হারা সন্তানের নীরব কান্নাকে ভাষায় কিংবা ছন্দে রূপ দিতে পারেন। মা সন্তানের জন্য সর্বপেক্ষা প্রিয় ও সর্বাধিক উচ্চারিত নাম।সহধর্মিণী সেলিনা বেগমের সাথে সর্বশেষ কথা হয় ১৭ জুলাই রাত ১২ টায় ইবনেসিনা হাসপাতালে তার শয্যাপাশে বসে। অন্য সময়ের চেয়ে সে সময় স্বাভাবিক কথাবার্তা বলছিলেন সে। আমি কোথায় থাকবো, কি খাবো জানতে চাইলো। আমার থাকা-খাওয়ার বিবরণ শুনে বললÑ মোমিনার আম্মার (আমার বড় ভাবী) বাসায় যাও। জরুরি বিভাগের চেয়ারে বসে ঘুমাতে পারবে না। তোমার অনেক কষ্ট হবে। রাত ১ টা পর্যন্ত পারিবারিক নানা আলাপ-আলোচনা হলো। চলে আসবো ঠিক এই মুহূর্তে বললÑ তোমার সাথে থাকা টাকাগুলো কিছু নিজের কাছে রেখে বাকিটা তানিয়ার নিকট রেখে যাও। জরুরি বিভাগে অনেক মানুষ। ঘুমিয়ে গেলে কেউ টাকা নিয়ে যেতে পারে। তার এ পরামর্শে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে টাকাগুলো রেখে গেলাম। এই কথপোকথনের ৪ ঘণ্টা পড়েই যে সে চলে যাবেনÑ কে জানতো সেটা! সে কথপোকথনগুলো চিরকাল আমার হৃদয়ে বাজবে। আমার সাথে আমার সহধর্মিণীর সর্বশেষ কথপোকথন যে এটা।আমার জীবনের পাঁচালিতে সহধর্মিণী সেলিনার মৃত্যু শুধু বেদনার নয়, অগণিত স্মৃতির জন্মদাতাও। সেলিনার অজ¯্র স্মৃতি লুকিয়ে আছে আমার হৃদয়ে। ২৪ বছরের দাম্পত্য জীবনের নানা ঘটনা আমাকে বারবার স্মৃতির সাগরে ঠেলে নিয়ে যায়। যেন হাত ধরে টেনে নিয়ে হাজির হয় নববধূ থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পুরো দাম্পত্য জীবনে। তাকে বাদ দিয়ে আমার জীবনের ইতিহাস রচিত হতে পারে না। শত চেষ্টা করেও তাকে আমার হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যাবে না। কারণ সে আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।গুণী সহধর্মিণী সেলিনার সঙ্গে দাম্পত্য জীবনের নানা ঘটনার কিছুটা স্মৃতিচারণ এখানে করতে চাই। তার সঙ্গে আমার শুভবিবাহ অনুষ্ঠিত হয় ৯ জানুয়ারি ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে। এই ২৪ বছরে স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব-কর্তব্য কতটা সুচারুভাবে পালিত হয়েছে সে বিচারের যোগ্য বিচারক আমি নই। তাই তা থেকে বিরত থাকবো। অধিকন্তু আমি আদর্শ স্বামী নই বলে তাকে স্ত্রীর যথাযথ মূল্যায়ন দিতে পারিনি কোনদিন। সব সময় ব্যস্ত থেকেছি সৃজনশীলদের সাথে আড্ডা দিয়ে। আমার স্ত্রীর তেমন চাওয়া-পাওয়া ছিল না বলে সারাক্ষণ সাংবাদিকতা ও সেবামূলক কাজের সাথে লেগে থাকা আমার জন্য কঠিন হয়নি। সে ছিল অত্যন্ত মিতব্যয়ী। সন্তানদের পড়ালেখা, জমি চাষ এক কথায় সংসার পরিচালনায় সকল ক্ষেত্রে সে ভূমিকা রেখেছে। তার হিসেবী সংসার পরিচালনা এবং ধর্মভীরুতা সমাজের অন্য নারীদের জন্য প্রেরণা হয়ে থাকবে।আমার সমধর্মিণীর অসাধারণ উষ্ণ হৃদয়ের পরশ দু’যুগ পেয়েছি। মুগ্ধ হয়েছি তাহাজ্জতসহ তার পাঞ্জেগানা নামাজ আদায়ে, ধর্মের প্রতি আন্তরিকতায়। তিনি ধর্মীয় অনুশাসন পালন করতেন অসাধারণ ভালোবাসার উষ্ণতার স্পর্শ দিয়ে। যা ছিল অত্যন্ত আন্তরিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত। বর্তমান সমাজে এমন ধর্মপরায়ণ স্ত্রী সবার ভাগ্যে জোটে না। দুর্ভাগ্য আমার গুণবতী স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না। নিজ ধর্মের প্রতি তার অন্তহীন ভালোবাসা আমি লক্ষ্য করেছি, উপলব্ধি করেছি। তিনি চাইতেন আমি ধর্মীয় অনুশাসন যথাযথভাবে মেনে চলি, চাইতেন সন্তানদের ধর্মপ্রাণ সুসন্তান হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে। তাই তিনি আমাকে আন্তরিকভাবে বলতেনÑ আমি যেন নিজেকে যুক্ত করি সন্তানদের ধর্মপ্রাণ বানাতে। বলতেনÑ আল্লাহর নির্দেশ পালনকারী সোহাগী স্বামীর সৌরভ কপালে মেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারলে সে স্ত্রী ভাগ্যবান। তাই তোমার নিকট ধনদৌলত, বাড়িগাড়ি চাই না। চাই তুমি আল্লাহর হুকুম যথাযথভাবে পালন কর। ব্যথা ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বেদনার্ত স্বরে বলতেনÑ আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। আমি বিশ^াস করি জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। আমার জন্য দোয়া করো যেন দুনিয়া থেকে বিদায়ের সময় কালেমা তাইয়্যেবা, আল্লাহ এবং রাসুল (স.)-এর নাম যপে যেতে পারি দরদী কণ্ঠে। তার এসব কথা কোনদিন আমার স্মৃতিপট থেকে মুছে ফেলতে পারবো না। এ মানুষটি কি করে এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলÑ এর কি কোন উত্তর আছে? কোন উত্তর নেই। তবে আমরা জানি মহাপ্রাণ মানুষের মৃত্যু নেই, তারা মৃত্যুঞ্জয়ী। আমার বিশ^াস আমার সমধর্মিণী সেলিনাও হবে মৃত্যুঞ্জয়ী। কারণ তার সকল কর্মে ছিল ইসলামের ছোঁয়া। যেগুলো চির ভাস্বর, চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।সেলিনা অবসরে মোবাইল ফোনে বিখ্যাত আলেমদের ওয়াজ ও হামদ্-নাত উদ্ভাসিত হয়ে পরম আন্তরিকতায় সঙ্গে শ্রবণ করতো। ধর্মীয় জলসায় যেতে কি যে উৎসাহ ছিল! ক্লান্তিহীন রাত জেগে ধর্মসভা শুনতো। ধর্মকে জীবনের পাথেয় বানাতে বড় স্বপ্ন ছিল তার। যেসব গুণ থাকলে একজন নারীকে ধার্মিক রমণী বলা যায় তার সবই ছিল তার মধ্যে। নারীদের ধর্মীয় অনুশাসন শিখাতে স্থানীয় সকল উদ্যোগে সে অংশ নিয়েছে। পর্দাসহ ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলতে তিনি ছিলেন দ্বিধাহীন। এলাকার সকল ধর্মপ্রাণ নারী তার ধর্মানুরাগের প্রশংসা করতেন। পরকালে মুক্তির জন্য ইসলামÑ এ বিশ^াসে তিনি ছিলেন অটল। সান্ত¡না এই যে, আমার সন্তানেরা ধর্মানুরাগী, পরহেজগার, হৃদয়ে আল্লাহর প্রেমজাগানিয়া মায়ের ভালোবাসা ও ¯েœহ পেয়েছে। তাদের মা ছিল ধর্মীয় অনুশাসন পালনে প্রেরণার জায়গা। আমাদের সমাজে এমন মায়ের ভালোবাসা পাওয়া শুধু বিরলই নয় অনন্যও। আর কখনো সন্তানরা মায়ের ভালোবাসা পাবে না। তার কণ্ঠে আর কখনো শুনবে না কোরআন তেলওয়াত। শুনবে না ইসলামি অনুশাসন পালনের তাড়া। তবে তার রেখে যাওয়া আদর্শ সন্তানদের ধর্মানুরাগী হতে উজ্জীবিত করবে।গত ১৩ জুলাই ক্যান্সার হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে রাস্তায় একটি ফিলিং স্টেশনে বাথরুম সাড়েন সেলিনা। দীর্ঘদিন পর তার স্বাভাবিক বাথরুম হয়। এ কারণে আমার মনে হয়েছিল ডাক্তারের রিপোর্ট ভুল। সবই ঠিক আছে। সেদিন আশায় বুকটা ভরে গিয়েছিল। বিশ^াস জন্মেছিল ক্যান্সার পরাস্থ করতে পারে নি আমার সহধর্মিণীকে। আমার সে বিশ্বাস ভুল প্রমাণিত হলো। মরণব্যাধি ক্যান্সারের সাথে লড়াইয়ে হেরে চলে গেলেন আমার সহধর্মিণী। তার সঙ্গে চিরদিনের জন্য সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল আমার। হে সহধর্মিণী তোমার অনন্ত যাত্রায় স্বামী হিসেবে আমার অশেষ দোয়া।আমার সহধর্মিণীর মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইজবুকে নানা বার্তায় শোক জানিয়েছেন গণমাধ্যম কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপোশার মানুষ। তার রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয়েছে সেসব পোস্টে। অনেকে আবেগে লিখেছেন শোক জানাবার ভাষা নেই।জানো সেলিনা, তুমি যখন দক্ষিণ লোকেরপাড়া ঈদগাহ মাঠে কফিনে শুয়েছিলে, তোমার ঘুম যখন ভাঙছিল না, আমি যখন মুসল্লিদের সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চোখে তোমার রুহের মাগফেরাতের জন্য সকলের নিকট দোয়া চাচ্ছি, ঠিক তখন সবার দৃষ্টি এড়িয়ে চুপি চুপি আমার কাছে এসে ফিস ফিস করে তুমি বললেÑ শুনেছ, শুচি-শিহাবকে তো আগে সময় দিতে পারনি, এখন কিন্তু ওদের সময় দিও। তুমি ছাড়া আর কে আছে ওদের? বিশ^াস কর সেলিনা, আমি বাহ্যিকভাবে সময় না দিলেও হৃদয়ে সব সময় ওদের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা রয়েছে। আর এখন তো বাধ্য হয়েই সময় দিতে হবে। আর শোন, তুমি তো সব সময় তোমার প্রিয় ভাগ্নে মওলানা রফিকুল ইসলামের মেধা ও প্রজ্ঞার প্রশংসা করতে। তার ধর্মানুরাগকে স্বাগত জানাতে। জান, সে রফিক মামাই তোমার জানাযায় ইমামতি করেছে। দাফন করা হয়েছে আমাদের দক্ষিণ লোকেরপাড়া কেন্দ্রীয় কবরস্থানে। এখানেই নীরবে-নির্বিঘেœ চিরশয্যায় ঘুমিয়ে থাকবে অনন্তকাল।পরিশেষে সশ্রদ্ধ সালাম হে প্রিয় সহধর্মিণী। ওপারে ভালো থেকো। হাশরের দিন তোমার নেকের পাল্লা ভারি হোক, তুমি জান্নাতবাসী হও।

পরিচিতি Ibrahim Bhuiyan

এটাও চেক করতে পারেন

ঘাটাইলের লোকেকরপাড়া ইউনিয়নে বিএনপি‘র পদযাত্রা

নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতীয়তাবাদী দল(বিএনপির) ঘোষিত দেয়া কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও নিত্য প্রয়োজনীয় …

Leave a Reply

Your email address will not be published.