লুৎফর রহমান বড়ো অসময়ে চলে গেলেন!
আনোয়ার হোসেন বকুল
তেরো অক্টোবর চলে গেলেন লুৎফর প্রফেসর। এলাকার মানুষের কাছে তিনি এ নামেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনে মা আমেনা বেগম হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। একই দিন মা-ছেলের মৃত্যু এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। পরিণত বয়সের আগেই লুৎফর রহমানের মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না কেউ। এলাকার সকল মানুষের সঙ্গে আমার শোক ও অশ্রু মিশে একাকার হয়ে গেছে। মানুষ তাঁকে আপনজন হিসেবে জানত। সকলের সাতেই তাঁর মধুর সম্পর্ক ছিল। সকলের এ প্রিয় মানুষটি বড়ো অসময়ে চলে গেলেন। শুনেছি গুণি মানুষর কীর্তির বহমানতা বয়ে যায়। তাঁরা অমলিন ভাবে বিরজ করেন। বেঁচে থাকেন মানুষের মাঝে।
লুৎফর ভাই’র মৃত্যুর সংবাদ শুনি ভূঞাপুর বাসস্টেন্ডে জনতা কম্পিউটারে বসে সাংবাদিক আতোয়ার রহমান মিন্টু ভাই’র নিকট। সংবাদ শুনে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলাম। আবেগ এবং শোকে মন টিকছিলনা। মিন্টু ভাইকে সাথে নিয়ে ছুটে যাই লুৎফর ভাই’র ভূঞাপুরের বাসায়। শোকাত মানুষের ভীড় ঠেলে গিয়ে দেখি লুৎফর ভাই শেষ ঘুম ঘুমিয়েছেন। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়াতেই আমার জিবন-মৃত্যু সর্ম্পকিত ভাবনা গুলো সচল হয়ে উঠে। মনে পড়ে বিখ্যাত সেই লালন সংগীত- খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, কেমনে আসে যায়/ ধরতে পারলে মনোবেরী দিতাম পাখির পায়। এসময় আমার দুই চোখ হয়ে উঠে অশ্রুসিক্ত। জিবন-মৃত্যুর ভাবনা আমরা নিত্যদিন ভাবিনা। কোন দিন আমার জিবন খাঁচার পাখি উড়াল দিয়ে চলে যাবে তা কি আমি জানি ?
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মার্চ টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ডাকিয়াপটল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন লুৎফর রহমান। তাঁর পিতার নাম জসিম উদ্দিন। মাতা আমেনা বেগম। লুৎফর রহমান ছাত্র জিবনে তুখোর ছাত্রনেতা ছিলেন। উত্তর টাঙ্গাইলে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে পরীক্ষিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। স্কৃল জিবন থেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রতি দূর্বল ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ছাত্র জিবনের পুরোটা জুড়ে ছিল আওয়ামী ছাত্রলীগ রাজনীতির চর্চা। সে সময় কালিহাতি উপজেলার নারান্দিয়া, ঘাটাইল উপজেলার আনেহলা ও লোকেরপাড়া ইউনিয়ন নিয়ে ছাত্রলীগের আঞ্চলিক কমিটি গঠিত হয়। তিনি সে কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি আনেহলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। সারা জিবন তিনি সাম্য, সামাজিক ন্যায় বিচার এবং শোষণহীন সমাজ ব্যাবস্থার পক্ষে লড়ে গেছেন। গত ১১ অক্টোবর ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির মিটিংএ অংশ গ্রহণ ছিল তাঁর জিবনের সর্বশেষ মিটিং।
কর্ম জিবনে ফলদা শিহাব উদ্দিন ডিগ্রী কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। শিক্ষার মান উন্নয়নে তিনি নিরলস ভাবে কাজ করে গেছেন। শিক্ষকদের বিভিন্ন দাবি আদায়ের আন্দোলনে তাঁর ছিল সরব উপস্থিতি। প্রবল আত্মবিশ^াসী লুৎফর রহমান নিজেকে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। লোকেরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আকরাম হোসেন খানের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব ছিল। সম্পর্কে আকরাম খান লুৎফর ভাই’র উকিল শশুর। জামাই-শশুর মিলে আব্দুল্লাহ আল হাকাম ভুট্টো ও বোরহান তালুকদারকে সঙ্গে নিয়ে এলাকাবাসীর সার্বিক সহযোগীতায় লোকেরপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুল প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা ছিল অভিস্মরণীয়।
শোক বিধুর পরিবেশেও আমার স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে লুৎফর ভাই’র সঙ্গে আমার নানা স্মৃতি। লুৎফর ভাই আমাকে খুবই ¯েœহ করতেন। আমার সাথে স্বাক্ষাৎ হলে চা-পান না খাওয়াইয়ে ছাড়তেন না। আমি কখনো বিল দিতে গেলে বলতো অন্য সময় দিস। তাঁর নিকট কেউ আমার পরিচয় জানতে চাইলে বলতেন আমর ছোট ভাই। আজ অনুভব করছি যারা মানুষকে আপন অন্তরে ধারণ করতে পারেন, মানুষ শুধু তাদেরই আত্মার আত্মীয় হয়। সু-সময় ও দু-সময়ে সঙ্গী হয়। আর সেই মানুষ মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায় না। কেউ তাঁর সাথে খারাপ আচরন করলে ব্যাবহার গুণে ধীরে ধীরে তাকে আপন করে নিতেন। আমি তাঁর নিকট শিক্ষনীয় অনেক কথা শ্রবণ করেছি। তিনি বলতেন, আমরা দেশকে ভালোবাসবো, মানুষকে ভালোবাসবো, জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে জানাবো বিনীত সালাম।
মৃত্যু এক অনিভার্য বাস্তবতা মৃত্যুকে এড়িয়ে চলার কোন উপায় নেই। তবুও কিছু মৃত্যু আছে মেনে নেওয়া যায়না। তেমনি একটি লুৎফর রহমানের মৃত্যু। কি দিয়ে শান্তনা দিব ঝরনা ভাবীকে। সে কিভাবে মেনে নেবেন স্বামীর অকাল মৃত্যু সেদিন ঝরনা ভাবীকে শান্তনা দেবার ভাষা আমরা খুঁজে পাইনি। সমবেদনার ভাষা কারো ছিলো না। বাবা-মা’র পরম ভালোবাসায় বেড়ে উঠেছে একমাত্র ছেলে বিশ^বিদ্যালয় ভর্তি প্রত্যাশি জামিনূর রহমান জেমস, ভূঞাপুর মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত জমজ দুই মেয়ে নুসরাত জাহান রিতু ও ইসরাত জাহান জিতু। ওদের গভীর মমতা অনাবিল আদর দিয়ে শোক ভোলাতে হবে স্বজনদের। অত্যান্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে লুৎফর ভাই’র অবর্তমানে ভাবী যাতে পরিবারের হাল ধরতে পারেন সে জন্য সহযোগীতা করতে হবে। জানি ভাবী শোককে শক্তিতে পরিনত করে আদর্শিক পারিবারিক পরিম-ল টিকিয়ে রাখতে প্রচেষ্টা চালাবেন নিরন্তর।
পাশর্^বর্তী গ্রাম ভূঞাপুর উপজেলার কাগমারীপাড়া এলাকার ছাত্র যুবকদের সমন্বেয়ে ‘মৌসুমী ক্রিড়া সংঘ’ নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠায় জড়িত ছিলেন লুৎফর রহমান। তিনি সংঘঠনটির সহ-সভাপতি ছিলেন। এ সংগঠনের উদ্দ্যোগে নিয়মিত বিভিন্ন খেলার আয়োজন হতো। বয়বৃদ্ধদের হা-ডু-ডু ও ফুটবল খেলার আয়োজন করে সমগ্র জেলায় আলোড়ন সৃষ্ঠি করেছিল সংগঠনটি।
বিল ঘেড়া ডাকিয়া পটল নামে যে গ্রামটিতে লুৎফর রহমান জন্মে ছিলেন সেই গ্রাম থেকে বাংলার রূপ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। বর্ষাকালে ঘুম থেকে উঠে দিগন্ত বিস্তৃত বিলের মধ্যে শাপলা ফুলের সমারোহ, কার্তিকে পানি কমে যাওয়ার পর মাটির নিচ থেকে শালুক তোলা ও বর্ষায় পানির সাথে পাল্লা দিয়ে আমন বাড়তে দেখেছেন লুৎফর রহমান। এ রকম প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ করে প্রকৃতির মতো উদার হয়েছিলেন তিনি। তাঁর জিবনের দুটি ঘটনা এ লেখায় তুলে ধরছি। যা তাঁর ঘনিষ্ঠ জন লিটন খাঁ’র নিকট থেকে শোনা। একদিন একটি মোরগ লুৎফর ভাইর মটর সাইকেলে চাপা পড়ে। তিনি মোরগটি জবাই করে মালিক খুঁজে বের করে পাঁচশত টাকা ও জবাইকৃত মোরগটি তার হাতে তুলে দেন। আরেকদিন ভূঞাপুরে পলিশা নামক স্থানে ৫-৬ বছরের একটি ছেলেকে এক মটর সাইলেক চালক ধাক্কা দিয়ে আহত করে চলে যায়। লুৎফর ভাই আহত রক্তাক্ত ছেলেটিকে পাঞ্জা কোলে তুলে স্বজনদের খোঁজেন। স্বজন খুঁজে না পেয়ে লুৎফর ভাই হাসপাতালে ভর্তি করে ছেলেটির চিকিৎসা করেন। পরে স্বজন এসে চিকিৎসার খরচ দিতে চাইলে লুৎফর ভাই বলেন, ছেলেটি যদি আমার হতো ?
দক্ষিণ লোকেরপাড়া ঈদগাঁ মাঠে লুৎফর ভাই’র নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ ঈদগাঁ মাঠের এ যাবৎ কালের জানাজা স্বাক্ষ্য দিবে এচেয়ে বড় জানাজা আর কোনটিই হয়নি। জানাজায় মানুষের যে ঢল নেমেছিলো তাতেই প্রতীয়মান হয়- কতোটা গুণি মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি সর্বস্তরের মানুষের গভীর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে নিজ গ্রামের কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন।
লেখক: সাংবাদিক ও মানবাদিকার কর্মী
আপনার মতামত লিখুন